ঢাকা , বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫ , ৪ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কারাগারে শিবির সভাপতি রঞ্জুর শেষ ইচ্ছে ছিল দুই রাকাত নামাজ পড়া।


আপডেট সময় : ২০২৫-০৮-১৯ ১৯:৫৬:১৫
কারাগারে শিবির সভাপতি রঞ্জুর শেষ ইচ্ছে ছিল দুই রাকাত নামাজ পড়া। কারাগারে শিবির সভাপতি রঞ্জুর শেষ ইচ্ছে ছিল দুই রাকাত নামাজ পড়া।



জহুরুল ইসলাম, নীলফামারী প্রতিনিধি: 

পতিত শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ভিন্নমতকে ধমন করাই ছিল আসল কাজ ক্ষমতার চেয়ারকে ঠিক রাখতে সকল চেষ্টাই করতো শেখ হাসিনার সরকার, তার ধমন পিরনের স্বীকার হয়েছিল ছাত্রশিবির নীলফামারী জেলা শাখার সভাপতি জাকির হোসেন রঞ্জু।

ইসলামী ছাত্রশিবির নীলফামারী জেলা শাখার সাবেক জেলা সভাপতি জাকির হোসেন রঞ্জু তার ফেসবুক আইডিতে লিখেন।

২০১৭ সালের সংক্ষেপে আগস্টের কিছু স্মৃতি আপনাদের সাথে শেয়ার করতেছি….১৮ই আগস্ট শুক্রবার সকাল ১০:৩০মিনিট. শিবিরের কর্মীদের মানোন্নয়নের জন্য কর্মী কন্টাক্ট। কন্টাক্ট শুরু হয়ে গেছে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত চলছে ঠিক ও-ই মূহুর্তে কমান্ডো স্টাইলে অত্যাধুনিক অস্ত্র-সজ্জিত র‍্যাব সদস্যরা চারদিক দিয়ে বন্দুক তাক করে রুমে প্রবেশ করেন। টেনে হিঁচড়ে বের করে রুম থেকে বারান্দায় নিয়ে আসেন। আমার প্রতি শুরু থেকেই তাদের টার্গেট ছিল। আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন?, বললাম আমি! পরিচয় দেওয়ার সাথে সাথে জোড়ে থাপ্পড় দেওয়া শুরু করলেন। আর আমার চোখ দিয়ে মনে হচ্ছে আকাশের তাঁরা গুলো ছুটে যাচ্ছে। এরপর জিজ্ঞাসা করলাম আপনারা কারা? আমাকে মারতেছেন কেন? তাঁরা কিছু না বলে তাদের আইডি কার্ড দেখানোর সাথে সাথে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেধে মাথা-বুক-কোমরে বন্দুক তাক করে, টেনে হিঁচড়ে বের করে লাথি-ঘুষি শুরু করলো কয়েকজনে। এতো নিকৃষ্ট ভাষায় গালাগাল প্রকাশ করা সম্ভব না। চোখ বেধে আমাদের একসাথে ৫ জনকে টেনে হিঁচড়ে বের করে গাড়িতে তুলে প্রথমত তাদের অফিসে নিয়ে যায়। আমরা ৫ জনের মধ্যে আমি, রায়হান ভাই, জলিল ভাই, আকিল ভাই আর আমাদের ছোট সাজু। তারা কোন মাধ্যমে আমার পরিচয় আগে জানতেন আমি শহর সভাপতি। আর আমাদের বাকিদের পরিচয় গুলো ওভাবে জানতেন না। তাদের থেকে আমাকে আলাদা করা হয়েছে। আমি বিষয় টি বুঝতে পারছি। আমাকে সামনে রেখে তারা একটা শর্ট মিটিং করলেন। মিটিংয়ে তাদের সিদ্ধান্ত হলো যদি কোন মিডিয়া এদের সন্ধানে আসেন তাহলে আমরা বলবো, আমরা কাউকে নিয়ে আসি নি।
 

এরপর হাতে হ্যান্ডকাফ, পায়েবেরি পরিয়ে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেধে শুরু হয়ে গেলো অমানবিক নির্যাতন।


প্রথমেই জিজ্ঞাসা-
তোমাদের অস্ত্র গুলো কোথায়! তুমি জ/ঙ্গী! কোথায় কোথায় তোমাদের প্রশিক্ষন হয়! জায়গার নাম দাও! আমাদের নিয়ম হচ্ছে যারা সত্য কথা বলে আমরা তাদেরকে সসম্মানে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি! নয়তো তোমার জীবন শেষ করে দেবো। তাড়াতাড়ি তথ্য দেও! এসব বলতেছেন আর বুক, মাথা পিস্তলটা তাক করে রাখছেন।


আমি উত্তর দিচ্ছি স্যার আমি তো শিবির করি। আমার সাথে যত ডকুমেন্টস আছে সব তো শিবিরের! আমরা কোথায় অস্ত্র পাব- এই কথা বলার সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো অমানবিক নির্যাতন। যা আসলে বর্ণনা করার মতো নয়। আমি কিছু সময় সেন্সলেস ছিলাম। জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি আর দাঁড়াইতে পারছিনা। হাঁটাচলা করতে পারছিলাম না। দুজনের গায়ে ভর দিয়ে চলছিলাম। নির্যাতনের সিস্টেম টা কখনো চেয়ার বসিয়ে, আবার কখনো চেয়ার টা সুয়ে পায়ের তালু গুলো উপ-র করে, আমরা রুকুতে যেভাবে যাই ঠিক সেভাবে করে কোমড় ভাঁজ করে রাবার স্টিক দিয়ে আঘাত করা।

এরপর গভীর রাতে একজন সিনিয়র কর্মকর্তার হিফাজতে দেন। তিনি রাতের খাবার ব্যবস্থা করেন। মধ্য রাতের খাবার টেবিলে রায়হান ভাইয়ের সাথে দেখা- দুজন দু’দিকে চোখে চোখে দেখছি আর চোখ দিয়ে ঝড় ঝড় করে পানি পড়ছে। একটু সুযোগ হলো কানে কানে কথা হচ্ছে আর মনে আমাদের দেখা হবে না।

তাদের নির্যাতনের হাতিয়ার ছিলো, রড, প্লাস, হাতিড়ি, লাঠি, রাবার স্টিক…. এর থেকেও আরো বেশি ভয়ানক একটা ছিলো…

এরপর, লম্বা একটা ঘটনা-চোখ বাঁধা অবস্থায় কোথায় আছি, কোথায় যাচ্ছি কিছুই জানি না-একজন এসে বলতেছে তোমাদের আজকেই শেষ দিন তোমাদের কোন ইচ্ছে থাকলে বলতে পারো। আমি আবেদন করলাম শেষবারের মতো মায়ের সাথে কথা বলতে চাই। আর শেষ সুযোগ হিসেবে দু’রাকাআত নফল নামাজ করতে চাই। মায়ের সাথে কথা বলার কারণে আবারো অমানবিক নির্যাতন শুরু করলেন। শেষে নফল নামাজ পড়ার সুযোগ করে দিলেন। নামাজ পড়ে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেধে বন্দুক তাক করে, বের করে গাড়িতে উঠে নিয়ে যান…..! তবে অযু ছাড়া কোন সময়ের জন্য চোখের বাঁধন খোলা ছিলো না।


আমাদের প্রতি যাতে কোন নির্যাতন করা না হয় সেজন্য আমার একজন প্রিয় মানুষ সচরাচর তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে গেছেন।


এরপর নির্ঘুম দুইরাত পরে, অনেক রাতে কোন এক জায়গা থেকে আমাদের সদর হাসপাতালে নিয়ে আসেন। প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট শেষে থানায় স্থানান্তর করেন। থানায়ও বেশ জটিলতার মধ্যে। এতো কিছু হয়ে গেছে আমার “মা” তখনও জানতেন না। কোন এক মাধ্যমে বড় বোন ও সাবেক জেলা আমীর আব্দুর রশিদ চাচার সাথে ফোনে কথা বলে নিশ্চিত করে আমরা এখন থানায় আছি। থানায় হস্তান্তরের পরে আমার বাবা আমার মা’কে থানায় নিয়ে আসেন। পরিবারের সদস্যদের কাউকে আমাদের কাছে আসতে দিচ্ছেন না। অনেক রিকুয়েষ্ট করে মা কাছে আসলেন কুশলাদি বিনিময়ে মা কে হাসতে হাসতে বলতেছি মা আমি ভালো আছি। গ্রেফতারের খবর শুনে অনেকই খবর নিতে আসছিলেন কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ তাদের কে আমার সাথে সাক্ষাত করতে দেন নি।


সে সময়, আমি প্রায় ২৩ দিন ঠিক মতো হাঁটতে, সুইতে পারতাম না। বিশেষ করে আমার তখনকার অবস্থা দেখে সৈয়দপুরের আবুল কালাম আজাদ চাচা, আব্দুল আলিম চাচা মাঝেমধ্যে বসে কান্না করতেন।


এরপর ৪৭ দিন কারাগারে থাকা অবস্থায় ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে এবং আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডের প্রথম দিনে প্রথমত আব্দুল জলিল ভাইকে নিয়ে যান। দীর্ঘ একটা সময় আব্দুর জলিল ভাইয়ের খোঁজ নাই। একটু ভয় কাজ করতেছিলো। মনের ভিতর অস্থিরতা কাজ করতেছিলো কারণ, জলিল ভাই আগে থেকে একটু অসুস্থ ছিলো। রিমান্ডে নানান স্টাইলে জিজ্ঞাসাবাদ ও অমানবিক আচরন করতেন। কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেধে জিজ্ঞাসাবাদ। ভয়ঙ্কর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
বিষয় একটাই- তোমরা জ/ঙ্গি, তোমাদের অ/স্ত্র গুলো কোথায়? তোমাদের টাকা দেয় কে বা কারা? তোমাদের নেতা কোথায় থাকে?
তাদের সাথে কাটানো সময় টা খুবই ভয়ংকর, উত্তর দিলেও দোষ না দিলেও দোষ।


রিমান্ড শেষে আবার কারাগারে পাঠানো হয়। আমি তখন অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলাম। সে সময় আমার অনার্স ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। পরীক্ষাগুলো জেলখানায় বসেই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল ভাইভা গুলো আমাকে দিতে দেওয়া হয়নি। পরে বিশ্ববিদ্যালয় বোর্ড গিয়ে বোর্ড কন্ট্রোলার এর সাথে কথা বলার পর। অতিরিক্ত ফি জমা দিয়ে পরীক্ষা দেওয়া হয়।
ঐ সময়ের একটা কুরবানির ঈদ আমাদের করতে হয়েছে। ঈদের দিনের অনেক স্মৃতি। বিশেষ করে ঈদর দিন পরিবার সহ এলাকার অনেক মানুষ কারাগারে সাক্ষাত করতে যান। এটা ছিলো আমার প্রতি তাদের ভালোবাসা। আব্বা, মা আর দুলাভাই প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন অফিস কলে সাক্ষাত করতেন। কারাগারে থাকাকালীন সময়ে মায়ের খুব কষ্ট হয়েছে। সে সময় বাহিরে থেকে সাংগঠনিক ব্যক্তিদের মধ্যে মইনুল ইসলাম, বিপ্লব ভাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট করছে। কারাগারে ঔষুধ, খাবার সার্বিক খোঁজ খবর রেখেছেন। ভিতরে আব্দুল জলিল ভাই আমার জন্য অনেক সেবা করছেন।

সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কিছু শারীরিক অসুস্থ নিয়ামত লেগে আছে। এর মধ্যে উন্নত চিকিৎসার জন্য দু’বার ইন্ডিয়ার চেন্নাইতে যাওয়া হয়েছিল। সবমিলিয়ে দু’আ চাই। রব্বেকারিম যেন সুস্থ রাখেন, বাকী জিন্দেগী টা ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের জন্য নিবেদিত থাকতে পারি।


সবকিছুর বিনিময় হোক পরকালীন নাজাত-
মঞ্জিল হোক চির সুখের জান্নাত-

প্লিজ আপনাদের দু’আ ও ভালোবাসা আমার জন্য অব্যাহত রাখবেন।

বর্তমান জাকির হোসেন রঞ্জু জামায়াতে ইসলামী নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলা শিমুলবারী ইউনিয়ন যুব-বিভাগের সভাপতির দায়িত্বে আছেন।

 






 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Banglar Alo News Admin

কমেন্ট বক্স

প্রতিবেদকের তথ্য

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ